জনপ্রিয় পোস্টসমূহ

বৃহস্পতিবার, ১ জানুয়ারী, ২০১৫

মধ্যরাতে কুমিরা রেলস্টেশনেঃ সংগৃহীত


যারা মোবাইল অপারেটর বা তাদের ভেন্ডর কোম্পানিগুলোতে কাজ করেন, তারা জানেন যে নেটওয়ার্কের মেইনটিনেন্সের জন্য প্রায়ই রাতে কাজ করতে হয়। রাতের এ কাজকে 'প্ল্যান্ড ওয়ার্ক' বলা হয়। আমি যেহেতু একটি মোবাইল অপারেটর প্রতিষ্ঠানের অপারেশন্সে কর্মরত আছি, তাই আমারও অনেক সময় রাতে 'প্ল্যান্ড ওয়ার্ক' থাকে। 'প্ল্যান্ড ওয়ার্ক' থাকলে সারারাত কাজ করে সকালে বাসায় ফিরি।
এবার মূল ঘটনায় আসি। প্রথমে আমার পোস্টিং ছিল চট্টগ্রামে। ঘটনাটি ঘটেছিল চিটাগাং শহর থেকে সীতাকুণ্ডের দিকে যেতে মধ্যবর্তী কুমিরা নামক স্থানে। ঘটনার রাতে আমার 'প্ল্যান্ড ওয়ার্ক' ছিল কুমিরা রেলস্টেশনের কাছের একটি মোবাইল বেসস্টেশনে। গ্রামে বিসতৃর্ণ বিশাল মাঠের মাঝে অথবা শহরে সুউচ্চ অট্টালিকার ছাদের ওপরে টাওয়ার এবং তার সাথে একটি ঘর অনেকেই দেখেছেন। একেই সংক্ষেপে বলে বেসস্টেশন (আসলে বিটিএস বা বেস ট্রান্সিভার স্টেশন)। বেসস্টেশনগুলোতে বিভিন্ন যন্ত্রপাতি থাকে। সেসব যন্ত্রপাতির মধ্যে থাকে 'রেডিও ইকুইপমেন্ট' এবং 'ট্রান্সমিশন ইকুইপমেন্ট'। ক্যাবল বা তারের সাহায্যে ল্যাপটপে ইনস্টল করা সফটওয়্যার দিয়ে এসব যন্ত্রপাতিতে লগ-ইন করতে হয়। তারপর প্রয়োজনীয় কমান্ড দিয়ে কাজ করতে হয়।
রাত দুটোয় ছিল আমার কাজ। আমি কুমিরা রেলস্টেশনে পৌঁছলাম রাত দেড়টার দিকে। তখন স্টেশনটি ছিল একদম জনমানবহীন। গাড়ি রেলস্টেশনের কাছেই রাখতে হয়; তাই ড্রাইভারকে সেখানে গাড়িটা রাখতে বলে আমি টর্চ জ্বালিয়ে রেললাইনের পাশের বালুর পথ ধরে বেসস্টেশনের দিকে হাঁটতে শুরু করলাম। চারদিকে তখন পিনপতন নিস্তব্ধতা। রাতটাও মনে হয় ছিল অমাবস্যার। আশেপাশের কিছুই তেমন পরিস্কার দেখা যাচ্ছিল না। যতদূর চোখ যাচ্ছিল, শুধুই নিকষ কালো অন্ধকার! দূরের বিশাল বিশাল গাছগুলোকে কেমন জানি অতিপ্রাকৃত মনে হচ্ছিল। তবে আকাশের তারাগুলো স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল। আকাশে ছিল অগণিত তারা; তারার ওপর তারা ঠেঁসে যেন আলোকবিন্দুর সতূপ তৈরি হয়েছে! সব মিলিয়ে সেই আধিভৌতিক পরিবেশে কিছুটা ভয় এসে ভর করল আমার ওপর। ভয়ের মতো ভয়ংকর পরজীবী বস্তু পৃথিবীতে নেই! অন্য পরজীবীদের ভ্যাকসিন বা ঔষধে মোকাবিলা বাগায়েব করা যায়। কিন্তু ভয়কে মোকাবিলা করার কোনো অস্ত্র নেই। তবে অন্য পরজীবী দেহের 'পুষ্টি' শুঁষে নিলেও ভয় শুধু চায় 'প্রশ্রয়'। আমি বুঝতে পারছিলাম যে, ভয়কে যথেষ্ট প্রশ্রয় দিয়ে ফেলছি। একটু পরেই ফণা তুলে সে আমাকেই ধাওয়া করবে।
ধীরে ধীরে আমার হাঁটার গতি দ্রুত হতে লাগল। টর্চের আলো সামনে ফেলতে ফেলতে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ আঁতকে উঠে থমকে দাঁড়িয়ে পড়লাম। দেখলাম, একটা কুচকুচে কালো রঙের বিশালাকৃতির বিড়াল স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আমার দিকেই তাকিয়ে আছে। অতিমাত্রায় নিস্তব্ধ পরিবেশে কানে বোধহয় ধাপা ধরে গিয়েছিল। চারপাশের কোনো শব্দই কানে আসছিল না। টর্চের আলোতে বিড়ালের জ্বলজ্বলে চোখ দুটোর দিকে তাকিয়ে ভয়ে হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে এল। খানিক বাদে বিড়ালটাই উল্টো ঘুরে দৌড় দিল। আমি সেখানে আর দাঁড়িয়ে না থেকে দ্রুত হেঁটে বেসস্টেশনে পৌঁছলাম। বেসস্টেশনের রুমের মধ্যে ঢুকেই রুমের লাইট জ্বালানোর পর যেন জানে পানি ফিরে পেলাম।
সে রাতে একসাথে আরও কয়েকটা বেসস্টেশনে অপটিক্যাল ফাইবার নিয়ে কাজ হচ্ছিল। বিভিন্ন লোকেশনে থাকা ইঞ্জিনিয়ারদের সাথে মোবাইলে কথা বলতে বলতে কাজ করছিলাম। হঠাৎ অন্য বেসস্টেশনে থাকা এক ইঞ্জিনিয়ার ভাইয়ার সামান্য ভুলের কারণে নেটওয়ার্ক ডাউন হয়ে গেল। নেটওয়ার্ক ডাউন হওয়াতে কারও সাথে তখন যোগাযোগের কোনো উপায় নেই, তাই আমি নেটওয়ার্ক আপ হওয়ার অপেক্ষায় চুপচাপ বসে রইলাম। 'বিপদ যখন আসে, চতুর্দিক দিয়েই আসে'-এই কথাটার বক্তাকে খুঁজে বের করে নোবেল পুরষ্কার দেওয়া উচিত। অতি সত্যি একটি কথা। আমিও এর সত্যতা হাড়ে-হাড়ে টের পেলাম। কারণ কয়েক মিনিট পরেই চলে গেল বিদু্যৎ! মুহূর্তেই আমার পুরো শরীর ভয়ে জমে ঠাণ্ডা হয়ে গেল। হাত-পা যেন অবশ হয়ে গেল। সেই মুহূর্তে নিজেকে কেমন জানি ওজনহীন মনে হচ্ছিল; পায়ের তলা থেকে যেন মাটি সরে গেছে! অন্ধকারে মনে হলো, কোনো কালো ছায়া আমার ঘাড়ের পেছনে রক্তমাখা দাঁত বের করে দাঁড়িয়ে আছে। ঝট করে পেছনে ঘুরে দাঁড়ালাম। মনে হলো, কালো ছায়াটাও স্থান পরিবর্তন করে আবার আমার পেছনেই এসে দাঁড়িয়েছে। শুনেছি, মানুষ ভয় পেলে বৃক্কীয় গ্রন্থি থেকে অ্যাড্রেনালিন হরমোন নিঃসৃত হয়। এই হরমোন মানুষকে শান্ত ও স্বাভাবিক করতে সাহায্য করে। কিন্তু আমি শান্ত হওয়া তো দূরে থাক, আরও অস্থির হয়ে উঠলাম। কারণ, মনে হচ্ছিল ছায়াটা ধীরে ধীরে আমার চারপাশে বিসতৃত হয়ে আমাকে গিলে ফেলতে চাইছে। আমি আড়চোখে ডানে-বামের দেওয়ালে তাকাতেই সেই কালো ছায়াকে যেন প্রসারিত হতে দেখলাম। টর্চ জ্বালিয়ে হুড়মুড় করে বাইরে চলে এলাম। গাড়ি যেদিকে দাঁড়ানো ছিল, সেদিকে জোরে হাঁটা ধরলাম।
আবারও মনে হলো, একটা ছায়া আমাকে ফলো করছে। এবারও একদম উল্টো ঘুরে পেছনে টর্চ মারলাম। সামনে যতদূর চোখ গেল, কাউকে দেখতে পেলাম না। তবে দূর থেকে টাওয়ারের মাথায় চোখ পড়তেই মনে হলো, সেখানে কেউ বসে আছে। ভালোভাবে লক্ষ্য করলাম, কেউ একজন টাওয়ারের ওপরে বসে পা দুলাচ্ছিল। আর স্থির থাকতে পারলাম না। টর্চ জ্বালিয়ে গাড়ির দিকে রুদ্ধশ্বাসে দৌড় দিলাম।
অল্প সময় দৌড়ানোর পরই একটা লোককে আমার দিকে আসতে দেখলাম। কিছুটা শান্ত হলাম। ঘুটঘুঁটে অন্ধকারে গায়ে চাদর জড়ানো লোকটির মুখ ছিল একপ্রকার অস্পষ্টই। লোকটি যখন আমাকে পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছিল, তখন আমার দিকে তাকাতেই আমি আঁতকে উঠলাম। ভয়ংকর সেই লোকটা কিছু একটা চিবিয়ে খাচ্ছিল। সবচেয়ে ভয় পেলাম, তার মুখের চারপাশে লেগে থাকা রক্ত দেখে। 'ওয়াক থু' বলে সে মুখে জমে থাকা কিছু পরিমাণ রক্ত বালুর পথের ওপর ফেলল। তারপর আমার দিকে অগি্নদৃষ্টিতে তাকাল। লোকটির চেহারায় ছিল অস্বাভাবিক কাঠিন্য! চেহারা স্পষ্ট দেখতে না পাওয়াতে আমার কাছে আরও বিকটদর্শণ মনে হচ্ছিল। তখন আমাকে ভয় এতটাই গ্রাস করেছিল যে, মুখের চামড়ায় ভাঁজ পড়া ড্রাকুলা দেখতে যেমন হয়, লোকটিকে আমার স্রেফ তেমনই মনে হচ্ছিল! আমি কোনো দিক না তাকিয়ে দিলাম দৌড়। একটু সামনে গিয়ে পেছনে টর্চ মেরে দেখি লোকটা নেই। আর বেশি কিছু চিন্তা না করে দৌড়াতে লাগলাম। গাড়িতে কাছে পৌঁছে মনে হলো, নতুন জীবন ফিরে পেলাম।
ইলেকট্রিসিটি আসার পর আবার টর্চ জ্বালিয়ে বেসস্টেশনের দিকে রওনা দিলাম। রেললাইনের পাশের বালুর রাস্তা ধরে হাঁটতে হাঁটতে বেসস্টেশনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলাম। পায়েহাঁটা রাস্তার বালুতে, আমাকে পাশ কাটিয়ে চলে যাওয়া লোকটির পায়ের ছাপগুলো দেখে আমি শিউরে উঠলাম। লোকটির পায়ের ছাপগুলো ছিল উল্টো!
পাদটীকা: আমার এই ঘটনার একটা ব্যাখ্যা আমি বের করতে সক্ষম হয়েছি। আসলে প্রচণ্ড ভয়ে আমার হ্যালুসিনেশন হচ্ছিল। এক ডাক্তার বন্ধুর কাছে জানতে পেরেছি, হ্যালুসিনেশন হলে এমনটা হতে পারে। বেসস্টেশনের কালো ছায়া অথবা টাওয়ারের ওপরে বসে পা দুলাতে থাকা জলজ্যান্ত মানুষ ছিল আমার হ্যালুসিনেশনের ফল। আর আমাকে পাশ কাটিয়ে চলে যাওয়া লোকটি আসলে পান চিবাচ্ছিল। আমি প্রচণ্ড ভয় পেয়েছিলাম বলে ইলিউশনের কারণে তার মুখটা আমার কাছে রক্তামাখা ও বিকৃত মনে হয়েছিল। পরে কাজ শেষে সকালে ফেরার সময় রেললাইনের পাশের বালুর পথে পানের পিক পড়ে থাকতে দেখেছি। সেই জায়গাতেই লোকটা মুখ থেকে রক্ত ফেলেছিল বলে আমি ভেবেছিলাম। পানের পিক প্রায় শুকিয়ে গিয়েছিল বলে চিনতে অসুবিধা হয়নি। আর লোকটির পায়ের ছাপ আমাকে সেই মুহূর্তে ভয় পাইয়ে দিলেও সেটা আসলে সেই পথ ধরে হেঁটে যাওয়া অন্য কোনো মানুষের পায়ের ছাপ ছিল। ঐ লোকটির পায়ের ছাপ ফেরার পথে দেখতে পেয়েছি। এ ধরণের ঘটনাগুলো আমাদের জীবনে ভৌতিক অভিজ্ঞতার জন্ম দেয়। আর আমরা যখন তা কাছের মানুষদের কাছে বলি, তখন তা আরও রোমহর্ষক হয়ে ছড়িয়ে পড়ে মুখে মুখে।...............। ০০৭
নতুন ঘরে জিন নিয়ে বাস্তব গল্প পরতে ক্লিক করুন এখানে...

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন